মনে আছে তো সেই বিখ্যাত ঠাঁইবদলের কথা ? অসময়ে গান ধরে যে দোষ করে ফেলেছিল বিদেশিরা তারপর রাজার নিদান – “বিদেশী! তা হলে নিয়ম খাটবে না। একবার সকলে ঠাঁই বদল করে নাও, তা হলেই দোষ যাবে কেটে”। অথচ কি মজা দেখুন, সেই বিদেশিরা তো রাজাকে খুশিই করতে চেয়েছিল, কিন্তু কে জানত হিতে বিপরীত হবে। যাকগে, এসব সে রাজরাজড়ার যুগের কথা, আমাদের মত প্রজাদের এসব ভেবে কি লাভ।
এরপরে নিশ্চয় অনেকেই প্রশ্ন করবেন ভেবে যদি সেরকম কোনও লাভই নেই তখন অনর্থক ঢেঁকির সামনে বসে শিবের গাজন ধরেছ কেন হে মূর্খ ? বলেছেন ঠিকই। কিন্তু এত কথা বলার কারণ ঐ দোষ এবং দোষ কাটাতে ঠাঁইবদল। প্রশ্ন উঠে যায় তখন, যখন দেখা যায় সেরকম কোনও দোষ না থাকা সত্ত্বেও ঠাঁইবদল ঘটে। আজ্ঞে হ্যাঁ, বহুদিন হল একটি এইরকম ঠাঁইবদল নিয়ে কথা উঠেছিল, এখনও আড়ালে আবডালে চলছে। যার কেন্দ্রে রয়েছে একটি বই এবং তার পরিসীমা বরাবর বিখ্যাত পিতা-পুত্র। বইটির নাম – আবোল তাবোল। বাকিদের পরিচিতি নিঃসন্দেহে নিষ্প্রয়োজন।
এই ঠাঁইবদল-এর কাহিনীতে প্রবেশ করার আগে যেসব কুশীলবদের সাহায্য পেয়েছি তাদের সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিছু কথা
আবোল তাবোল – নব-সংস্করণ ১৩৫১, প্রকাশক সিগনেট প্রেস
জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ সুকুমার সাহিত্যসমগ্র, প্রথম খন্ড – সম্পাদক সত্যজিৎ রায় ও পার্থ বসু, প্রথম সংস্করণ – ১৯৭৩, দ্বিতীয় মুদ্রণ ১৯৯৫, প্রকাশক আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
আবোল তাবোল প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯শে সেপ্টেম্বর ১৯২৩ তারিখে। খুব স্বাভাবিকভাবেই ইউ রায় অ্যান্ড সন্স এই বইটির প্রকাশক ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সুকুমারের মৃত্যুর মাত্র আড়াই বছরের মাথায় এই প্রকাশনা সংস্থার হাতবদল হয় এবং যদ্দূর জানা যায় ১৯৩৮ সাল নাগাদ সেই মালিকানাধীন প্রকাশনা সংস্থা থেকেই এই বইটির ষষ্ঠ তথা খুব সম্ভবত এই প্রকাশনা সংস্থা থেকে শেষ সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
এর আরও পাঁচ বছর পরে প্রতিষ্ঠিত হয় সিগনেট প্রেস। প্রতিষ্ঠার এক বছর পরে প্রকাশিত হয় আবোল তাবোল – নব-সংস্করণ। অর্থাৎ লেখকপুত্র তখন তেইশ বছর বর্ষীয় নবীন যুবক। এই বইটির প্রিন্টার্স লাইন থেকে জানা যায় এই বইটির কিছু ছবি সত্যজিৎ রায় এঁকেছিলেন। যদিও বইটি দেখে খুব পরিষ্কার করে বোঝা মুশকিল যে ঠিক কোন ছবি ওঁর আঁকা। সেটা বুঝতে ব্যর্থ হলেও এইটুকু অন্তত বোঝা যায় যে আবোল তাবোল খুব সম্ভবত এই নব-সংস্করণেই প্রথমবার পরিবর্তিত হয় যদিও সেখানে সত্যজিৎ রায়ের কোনও ভূমিকা ছিল কিনা সে বিষয়ে আমার সংশয় আছে। যেমন ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের আবোল তাবোল না দেখতে পাওয়ার কারণে এটাও অজানা যে এই নব-সংস্করণ কোনও ঠাঁইবদলকে প্রশ্রয় দিয়েছিল কিনা। যদিও সন্দেহ উস্কে দেয় বইটির শুরুতেই “মূল-সংস্করণে যা কিছু ছিলো সবই এ নব-সংস্করণে বর্তমান – অদল-বদল শুধু সজ্জা-বিন্যাসে” (বানান গ্রন্থানুগ) এই স্বীকারোক্তি।
যাই হোক, এবারে আসা যাক দ্বিতীয় ঠাঁইবদলের প্রসঙ্গে (যদি সিগনেট প্রেসের নব-সংস্করণে প্রথম ঠাঁইবদলটি হয়ে থাকে)। এরপর থেকে ১৯৪৪ এবং ১৯৭৩ এইভাবে বইদুটির উল্লেখ করব।
প্রথমেই একটি কথা। ১৯৪৪ সালের বইটিতে দেখা যাচ্ছে একটি কৈফিয়ৎ। “যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই, সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে। গ্রন্থকার" (বানান গ্রন্থানুগ)। গ্রন্থকারকৃত এই কৈফিয়তটি ১৯৭৩ সালে অদৃশ্য। অবশ্য পুরোদস্তুর অদৃশ্য এমন কথা বলা ভুল, এটি প্রথম খন্ডের শেষে পুস্তক পরিচয় অংশে স্থানলাভ করেছে। ঠিক এইভাবেই ১৯৪৪ এবং ১৯৭৩ ছড়াগুলিও এদিক ওদিক। ১৯৪৪ সালে ‘গানের গুঁতো’ ছয় নম্বর স্থান দখল করলেও ১৯৭৩ সালে আট নম্বরে পিছিয়ে গেছে। একইভাবে ‘খুড়োর কল’ নড়তে নড়তে সপ্তম স্থানচ্যুত হয়ে দশম স্থানে স্থির হয়েছে। তবে শুধু পিছিয়ে যাওয়া নয়, ভাল ফলও করেছে কেউ কেউ। ১৯৪৪ সালে অষ্টাদশস্থানাধিকারী ‘ভাল রে ভাল’-র ঊনত্রিশ বছর পেরিয়ে এসে ষষ্ঠস্থান দখল কিংবা একবিংশস্থান থেকে ‘শব্দ-কল্প-দ্রুম’-এর নবম স্থান অধিকার এর উদাহরণ। যদিও সুচীপত্রে ‘শব্দ-কল্প দ্রুম’-কে হাইফেনটি ত্যাগ করতে হয়েছে।
অবশ্য এর চেয়েও অনেকবড় বিস্ময় সূচীপত্রে অপেক্ষা করে আছে। ১৯৪৪ সালে তালিকায় মোট সাতচল্লিশটি ছড়ার হদিশ পাওয়া গেলেও ১৯৭৩ সালে একটি কমে এসে ছেচল্লিশটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। এমন হওয়ার কারণ কি ?
আমার ব্যক্তিগত ধারণা এই কমে যাওয়ার সাথে ঠাঁইবদলের একটা যোগসূত্র রয়েছে এবং সেই যোগসূত্রের সাথে সাহিত্য ইত্যাদি সম্পর্করহিত। খুব সম্ভবত পাতার হিসেব ঠিক রাখতে এই সংক্ষিপ্তকরণ এবং ঠাঁইবদল। এই অবধি পড়ে অনেকেই, বিশেষত যাঁরা আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত দুটি গ্রন্থে ‘আবোল তাবোল’ পড়েছেন তাঁরা ভাবতে পারেন তবে কি পুরো ‘আবোল তাবোল’ পড়া হয়ে ওঠেনি, তাঁদের আশ্বস্ত করার জন্যে বলি – আবোল তাবোল-এর মোট সাতটি ছড়া শিরোনামবিহীন (ঊনত্রিশ বছরের ব্যবধানে এরাও নিজেদের মধ্যে জায়গা বদল করেছে)। এই সাতটি ছড়ার দুটি ‘মাসি গো মাসি’ এবং ‘বলব কি ভাই হুগলি গিয়ে’ এই দুটি ছড়া একসাথে ‘মাসি গো মাসি’ এই শিরোনাম বাহিত হয়ে ১৯৪৪ সালে সূচীপত্রে স্থান পেলেও বইটিতে শিরোনামহীন অবস্থায় প্রকাশিত হয়।
এই সব ঘটনাই ঘটেছে লেখকের মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। খুব সম্ভবত ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের হাতবদলের পরে রায় পরিবারের কোনও সদস্যের বইয়ের কপিরাইট তাঁদের উত্তরাধিকারদের কাছে ছিল না কারণ এই প্রকাশনা সংস্থা থেকে পরবর্তী সময়ে কেউ কোনো রয়্যালটি পাননি। এটা মেনে নিয়েও প্রশ্ন থেকেই যায় ১৯৩৮ সাল যে বইয়ের শেষ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে, মাত্র ৩৫ বছরের মধ্যে সেই বই কি এতটাই দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেল যে মূল বইটিকে অক্ষুণ্ণ রাখা কঠিন হয়ে উঠল। অস্বস্তি আরও বাড়ে যখন দেখি সাম্প্রতিককালে একটি প্রকাশনা সংস্থা থেকে মূল বইটি পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।
ঐতিহাসিক দিক দিয়েও আবোল তাবোল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বই। কারণ এই একটিমাত্র বইয়ের বুকমেকিং সুকুমার করে যেতে পেরেছিলেন। সেই বুক মেকিং কিভাবে হয়েছিল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ, ছড়াগুলি কিভাবে সুকুমার পাল্টে ফেলেছিলেন সে সবই রয়েছে জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ সুকুমার সাহিত্যসমগ্রে, শুধুমাত্র মূল বইটিই ব্যতিক্রম। এই বইটি যে গুরুত্ব, যে সম্মান দাবি করত, সেই গুরুত্ব, সেই সম্মান আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত দুটি সমগ্রে (একটি শিশুসাহিত্য, অন্যটি সাহিত্যসমগ্র) অন্তত অনুপস্থিত।
তো, এই হল অবস্থা। যদিও এ অবস্থাতেও 'আবোল তাবোল' একই রকম সুস্বাদু রয়ে গেছে। গ্রন্থকার তো বলেই দিয়েছেন ‘খেয়াল রসের বই’। খেয়াল রস নিয়ম মেনে চললেই তো বরং বিপদ। তবু একটা কথা বলতেই হচ্ছে। যতদিন ১৯৪৪ সালের বইটি চোখের বাইরে ছিল তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে অজ্ঞাত ছিলাম, ততদিন মনটা বেশ ফুরফুরে ছিল, কিন্তু দুটি রঙে মুদ্রিত এই বইটি দেখে প্রিয় গায়কের দুটি লাইন বারেবারেই গুনগুনিয়ে উঠছি
“কখনও সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে, ঠিক যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা”
ওহ, বলতে ভুলে গেছি – ১৯৪৪ সালে সুকুমারের আরও দুটি বইয়ের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল – একটি বহুরূপী, দাম এক টাকা বারো আনা, অন্যটি ঝালাপালা, দাম দু’টাকা। এবারে যে বইটি পড়ে এত কথা মনে এল তার দাম – একটু বেশিই – দু টাকা বারো আনা
একটু ছবিছাবা দিলে হত না সেই মূল সংস্করণের নতুন রূপের? বেশ কৌতূহল হচ্ছে।আবোল তাবোলের ব্যাপারে সত্যিই জানা ছিল না যে এত কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। প্রকাশকের হাতবদল ঘটেছে এটা জানা। কিন্তু কন্টেন্টও কমানো হয়েছে এটা জানতাম না।হস্তি দাকে অনেক বড় ধন্যযোগ এমন ভালো একটা বিষয় আমাদের সামনে আনার জন্য।
খুব ভালো, অত্যন্ত যত্ন নিয়ে লেখা ! আমার মনে পড়ে ছোটোবেলায় বাড়িতে দুটি আবোল-তাবোল ছিলো, তাদের দেখতেও আলাদা, একটা পুরোনো ছোটো হরফ, আরেকটা নতুন, পাতা, হরফ আলাদা, যদিও ‘নতুন’টা নকল-ও হতে পারে, সেসময় বাড়িতে অনেক ছোট্ট দোকান থেকে কেনা বই থাকতো যেগুলো প্রকাশনা কারা করতেন কেউ জানেনা … আমি বাচ্চা ছিলাম, নতুন বইটাই আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলো … এবারে ফিরলে খুঁজে দেখতে হবে সেই বইগুলো আর পাই কি না …
চমৎকার বিষয়। প্রথমেই হস্তীদা যে কুশীলবদের কথা উল্লেখ করেছে তাদের সম্পর্কে মনে করিয়ে দিই যে প্রথম কুশীলব একটা স্বতন্ত্র বই আর দ্বিতীয় কুশীলব সুকুমার রচনাবলীর অংশ। রচনাবলীতে স্বতন্ত্র বইকে হুবহু তুলে আনতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা কিন্তু নেই। কালানুক্রমে বা বিষয়ানুক্রমে সাজানোর জন্য অনেক সময়েই রচনাবলীতে স্বতন্ত্র বইয়ের কাঠামোকে ভাঙতে হয়। সেক্ষেত্রে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট রচনা কিভাবে স্বতন্ত্র বইতে প্রকাশিত হয়েছিল সেই তথ্য পরিশিষ্টতে থাকা জরুরী। কিন্তু “আবোল তাবোল” এর মত কাল্ট বইয়ের ক্ষেত্রে এই কাঠামো বদল করার প্রয়োজন বা সার্থকতা কতটা? মূল বইয়ের কাঠামোটাকে অবিকৃত রাখাই কাম্য ণোয় কি? সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে মূল বই কোনটা? সে উত্তর ও হস্তীদা দিয়েছেঃ “আবোল তাবোল প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯শে সেপ্টেম্বর ১৯২৩ তারিখে। খুব স্বাভাবিকভাবেই ইউ রায় অ্যান্ড সন্স এই বইটির প্রকাশক ছিলেন।” এখানে আরেকটা কথা আছে, ১৯৪৪ এর সিগনেট প্রেস প্রকাশিত “আবোল তাবোল” থেকে ১৯৭৩ এর আনন্দ প্রকাশিত “সুকুমার সাহিত্যসমগ্র”কে যদি ঠাঁইবদল বলতেই হয় তবে তা হবে তৃতীয় ঠাঁইবদল। দ্বিতীয় ঠাঁইবদল ছিল ১৯২৩ এর ইউ রায় অ্যান্ড সন্স সংস্করণ থেকে ১৯৪৪ এর সিগনেট সংস্করণ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঠাঁইবদলের কারিগর পুত্র ছিলেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ থাকতে পারে, প্রথম ঠাঁইবদলটি কিন্তু ঘটেছিল স্বয়ং পিতার হাত ধরে, সন্দেশ পত্রিকার পাতা থেকে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স এর বইতে। সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ছড়াগুলোকে সুকুমার নিজের হাতে সংশোধন করেন। আর সমস্ত ছবি নতুন করে আঁকেন। সেইসব সংশোধন করা পাতার কিছু ফটোকপি নভেম্বর ১৯৯৮ এর আবোল তাবোলের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত সন্দেশের বিশেষ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। একটা উদাহরণ দিইঃ সন্দেশে প্রকাশিত “খিচুড়ি” ছড়াটির তৃতীয় লাইন ছিলঃ “বক কহে কচ্ছপে – মনে ভারি ফূর্ত্তি”। সুকুমার প্রথমে “মনে ভারি” কে কেটে করেছেন “আহা কিবা”, সেটাকে আবার কেটে লিখেছেন “বাহবা কি”। শুধু তাই নয়, হাতিমি ও সিংহরিণ এর শেষ চারটে লাইন সন্দেশে ছিল না। সেগুলোকেও সন্দেশের কপিতে ছড়ার পাশে সুকুমারের হস্তাক্ষরে দেখা যাচ্ছে।
এখন কথা উঠতে পারে, পত্রিকায় প্রকাশ নয়, গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশ কেই মূল সংস্করণ হিসেবে ধরা উচিৎ, বিশেষতঃ সেইসব পরিবর্তন যখন গ্রন্থকার স্বয়ং করে গেছেন। হস্তীদা লিখেছেঃ “এইটুকু অন্তত বোঝা যায় যে আবোল তাবোল খুব সম্ভবত এই নব-সংস্করণেই প্রথমবার পরিবর্তিত হয় যদিও সেখানে সত্যজিৎ রায়ের কোনও ভূমিকা ছিল কিনা সে বিষয়ে আমার সংশয় আছে।” এ সংশয় নিরসন করতে সন্দেশ পত্রিকার ১৯৯৮ সালের উপরোক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত সিদ্ধার্থ ঘোষের “আবোল তাবোল তখন আর এখন” প্রবন্ধটির শরণাপন্ন হলাম। সিদ্ধার্থবাবু লিখেছেনঃ “মজার কথা, সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত আবোল তাবোল সংস্করণটির পরিকল্পনা অর্থাৎ ডিজাইন কিন্তু স্বয়ং সত্যজিৎ করেছিলেন। কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই, মামলায় জড়িয়ে পড়লে এবং হযবরল-এর প্যাঁচা-বিচারক তলব করলে নিশ্চয় প্রচুর ভুগতে হবে, তবু না লিখে পারছি না কয়েকটি কথা। সুকুমার রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে এবং আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত সুকুমার রায় রচনাবলীর তৃতীয় খণ্ড প্রকাশের সূত্রে নানা প্রয়োজনে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কিছু কাজ করার সুযোগ হয়। একদিন আবোল তাবোল-এর আদি সংস্করণের সঙ্গে তার সিগনেট সংস্করণের তফাৎ নিয়ে কথা ওঠে। সত্যজিৎ বলেছিলেন, সিগনেট সংস্করণে আবোল তাবোল নবরূপে ছেপে বেরোবার পর তাঁর মা, সুপ্রভা দেবী ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন ও বেশ কিছুদিন সত্যজিতের সঙ্গে কথা বলেননি। কেন ও কোন পরিস্থিতিতে সত্যজিৎ তাঁর বাবার হাতে গড়া আবোল তাবোল-এর চেহারা বদল করেন সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। জানা দরকার চেহারাটা কতটা ও কিভাবে বদলে গিয়েছিল।” ১৯২৩ এর আবোল তাবোলের চেহারা ছিল বাংলা পুঁথির মত। রাইটিং প্যাডের মত ওপরে বাঁধাই, নিচে পাতা উল্টোতে হত। প্রচ্ছদে ছিল তিনটে ছবি। মাঝখানে একটা বড় ছবি, দুপাশে দুটো ছোট ছোট ছবি। ১৯৪৪ এর আবোল তাবোলের প্রচ্ছদ হল শুধুমাত্র মাঝের ছবিটি নিয়ে, চেহারা হয়ে গেল আর পাঁচটা বইয়ের মত, বাঁদিকে বাঁধাই, ডানদিকে পাতা ওল্টানো।
প্রবন্ধটির শেষে সিদ্ধার্থ ঘোষের খেদোক্তি হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হবে নাঃ “পাগলা দাশু, হযবরল, দ্রিঘাংচু প্রভৃতির স্রষ্টা বইয়ের পাঠ বা শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই ক্ষ্যাপার মত একটি চরিত্র। ইস্কুল-শাসন ও ন্যায়-আইন ইত্যাদির বিরুদ্ধে ভাষাকে দাঁড় করাতে হলে যে আবোল তাবোল-ই সেরা সে বিষয়ে তাঁর দ্বিধা ছিল না। একই কারণে বই ছাপার রীতি-বিধির চলতি একুশে আইন অমান্য করে পুঁথির চেহারা দিয়ে আবোল তাবোলকে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন পুঁথি-পাঠেরই সমালোচনা রূপে। আবোল তাবোলের কবিতাগুলির মেজাজের সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ তাঁর এই বইটির পরিকল্পনা। দুর্ভাগ্য আমাদের, সিগনেট প্রেসের আমল থেকে আবোল তাবোলকে আমরা আরও চার-পাঁচজন ভদ্রলোকের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চেয়েছি। বইয়ের তাকে, আলমারিতে আবোল তাবোল তার আকারের স্পর্ধায় বা পাগলামিতে বাড়তি আবদার না জানায়।”
হাতিমি বা সিংহরিণ এর লাইনগুলি কিন্তু আমি পড়েছি। ওগুলো কি মাঝে গায়েব করে দেওয়া হয়েছিল কোনও সংস্করণে ?
ঐ লাইনগুলো সন্দেশে প্রথম প্রকাশের সময় ছিল না৷ আবোল তাবোল বই বের করার সময় সুকুমার ঐ চারটে লাইন যোগ করেন৷
কল্পতরু – ভাই, ছবি দিতে পারলাম না, কন্টেন্ট কমানো হয়নি, সূচিপত্রে স্থান পায়নি কেউ কেউ।
অতনু – তোমার লেখাটা পড়ে সিদ্ধার্থ ঘোষের প্রবন্ধটির কথা মনে পড়ল। তবে সন্দেশ নয়, সম্প্রতি প্রকাশিত সিদ্ধার্থ ঘোষের প্রবন্ধ সংগ্রহ প্রথম খণ্ডে পড়েছিলাম। এর সাথে আরও একটা অংশ বইটিতে খুঁজে পাওয়া গেল। বিভাব পত্রিকার শীত, ১৩৮৬ সংখ্যায় সত্যজিত লিখেছিলেন যে ওঁর ইচ্ছে ছিল বইটি অবিকৃত থাক কিন্তু “ডি.কে-র তাতে ঘোর আপত্তি, এবং আপত্তির প্রকাশ এমনই জবরদস্তি যে কার সাধ্যি তাকে খন্ডায়।” মূলত এই অংশটি আমাকে প্রলুব্ধ করেছিল “এই নব-সংস্করণেই প্রথমবার পরিবর্তিত হয় যদিও সেখানে সত্যজিৎ রায়ের কোনও ভূমিকা ছিল কিনা সে বিষয়ে আমার সংশয় আছে” এই বাক্যটি লিখতে। কিন্তু আমি ভুলেই গিয়েছিলাম এটার রেফারেন্স কোথায় পেয়েছি। সিদ্ধার্থ ঘোষের নামোল্লেখে মনে পড়ল।
সুকুমারের হাতে আবোল তাবোল কিভাবে পরিবর্তিৎ হয়েছিল তার বিস্তারিত দেওয়া আছে আনন্দ পাব্লিশার্সের জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ সুকুমার সাহিত্যসমগ্র তৃতীয় খন্ডে