গুল-বাগিচায় নৌ-বাহারের মরসুম। যৌবনের এই গুল-বাগিচার বুলবুলি, গোলাপ, চম্পা, চামেলি, ভ্রমর, প্রজাপতি, নহর, লতাকুঞ্জ, শারাব, সাকিচির- তাজা। এখানে চির-বসন্ত বিরাজিত। সাকির হাতে শিরাজির পেয়ালা, কবির বুকে দিল্রুবা, রবাব বেণু, আর গজল-গানের দীওয়ান। এই গুলিস্তানের কবি চির-তরুণ, চির-কিশোর। কবির অঙ্গে হেলান দিয়ে লীলায়িত-দেহা কবির মানসী প্রিয়া। ফিরোজা রং-এর ওড়না, গোধূলি-রঙের পেশোয়াজ-পরা সুর্মামাখা ডাগর চোখে তার বিকশিত প্রেমের নিলাজ আকুতি। এই শীর্ণা তন্বী কবি-প্রিয়ার হাতে মৌন বীণা, অধরে অভিমান, পায়ের কাছে পড়ে গোলাপকুঁড়ির গুচ্ছ। চঞ্চল কবিকে তার বিশ্বাস নেই, কোনো প্রেমের বন্ধনে যেন এই চঞ্চলকে বাঁধা যায় না। এই আনন্দ-বিলাসী প্রজাপতিটাকে সে তার কিঙ্খারের বক্ষ-আস্তরণে দিবানিশি লুকিয়ে রাখতে চায়,- প্রতি মুহূর্তেই হারাই-হারাই ভয়ে তার প্রেম চকিত, বেদনা-বিহ্বল। আকাশে চাঁদ-পৃথিবীর বুলবুলিস্তানে কবি-কাউকেই ধরা যায় না।

কবি ভাবেন-যৌবন আর ফুল সকালে ফুটে সন্ধ্যায় যায় ঝরে। ফুলের মালাকে মিলন-রাতের শেষে স্রোতে ফেলে দিতে হয়। -এই তার নিয়তি।

প্রতি মুহুর্তের আনন্দকে স্বীকার করে নিতে হয় তার উদ্ভবের শুভ মুহুর্তে। এ লগ্ন বয়ে গেলে-আর তা ফিরে আসে না। তাই সে হাতের ফুলকে কখন অভিনন্দিত করে, তখন না-ফোটা গোলাপের জন্য সে কাঁদে। যে ফুল ঝরে গেল, সেই মৃত ফুলের শবকে ধরে সে অতীতের শ্মশানে কঁদে না।

কবি তাঁর উন্মনা মানসীর আঁখি-প্রসাদ পাওয়ার জন্য গেয়ে ওঠেন-

[গান]

আধো আধো বোল, লাজে-বাধো-বাধো বোল্‌
বলো কানে কানে।

যে-কথাটি আধো রাতে মনে লাগায় দোল্-
বলো কানে কানে।।

যে-কথার কলি সখি আজও ফুটিল না,
শরমে মরম-পাতে দোলে আনমনা,
যে-কথাটি ঢেকে রাখে বুকের আঁচল-
বলো কানে কানে।।

যে-কথা লুকায়ে থাকে লাজ-নত চোখে,
না বলিতে যে কথাটি জানাজানি লোকে,
যে-কথাটি ধ’রে রাখে অধরের কোল-
বলো কানে কানে।।

যে-কথাটি বলিতে চাহ বেশভূষার ছলে,
বলে দেয় যে-কথা তব আঁখি পলে পলে,
যে-কথা বলিতে গিয়া গালে পড়ে টোল-
বলো কানে কানে।।